
দুনিয়ায় অনেক হতভাগা মা আছে। আমি সেই হতভাগা মায়েদের একজন। আমার বয়স যখন ষোল তখন বাবা-মা আমার বিয়ে দেন। ছেলে ভালো চাকরি করে। টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। আমি নাকি খুব সুখী হবো। সুখ কি তখনো বুঝি না। আর মা-বাবা আমার সুখের চিন্তা করে বিয়ে দিলেন। কিন্তু মা-বাবার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে একবছরের মাথায় আমার ডিবোর্স হয়ে গেলো। ডিবোর্স হলোও খুব তুচ্ছ কারণে। আমি নাকি আমার স্বামীকে পরিপূর্ণ সুখ দিতে পারিনা। অথচ ডিবোর্সের আগের রাতেও সে আমার শরীর নিয়ে মেতে ছিলো। হয়তো সেদিনই আমি কনসিভ করি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যারা আমাকে সুখী করার জন্য আমার বিয়ে দিলো তারাই ডিবোর্স হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি কটু কথা শুনালো। অবশ্য আমি তাদের কথা গায়ে মাখিনি। মা-বাবা কোনো কারণ ছাড়াই সন্তানকে কথা শুনানোর অধিকার রাখে।
ডিবোর্সের বাইশ দিন পর আমি বুঝতে পারলাম আমার স্বামীর সন্তান আমার পেটে। মাকে বিষয়টা জানানোর পর তিনি বললেন অবরসন করাতে। মার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। মা আমার কাধে হাত আশ্বস্ত করলেন,
-"তোর ভবিষ্যতের জন্য এটা দরকার মা।" মার কথা শুনে আমি মুচকি হেসে বললাম,
-" ঠিক আছে মা। ফল কাটার ছুরিটা তুমি আমার পেটে ডুকিয়ে দাও। যদি তুমি মা হয়ে নিজের সন্তানকে মারতে পারো তবে আমিও আমার সন্তানকে মারতে পারবো।" আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন।
সেদিন আমি মার কান্নার কারণ বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম যেদিন আমার বাচ্চা পেটে লাথি দিয়েছিলো। প্রতিটা লাথির কি অসহ্য যন্ত্রণা। পৃথিবীর কোনো পুরুষের হয়তো এই যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু প্রতিটা মা এই যন্ত্রণা সহ্য করে আনন্দে হাসে। এতোটা কষ্ট সহ্য করে সন্তান জন্ম দিয়ে যদি সেই সন্তানের জীবনে সুখ না আসে তাহলে প্রতিটা মা'ই কাঁদেন। আমার মাও হয়তো এই জন্যেই সেদিন কেঁদেছিলেন। আমার যখন নয় মাস হলো তখন থেকেই আমার বাচ্চা কেমন হবে, আমার বাচ্চার নাম কি রাখা হবে এসব নিয়ে মা কৌতুহলী হয়ে উঠলন। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার বাচ্চার জন্মের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। কিন্তু মা আমার বাচ্চাকে না দেখেই মরে গেলো। মরলোও খুব অদ্ভুত ভাবে।
একদিন সকালে মা আমার জন্য এক গ্লাস দুধ এনে আমার পাশে বসে বললেন,
-" শুনরে আশা, আমার ভেতরটা না কেমন খালি খালি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন সবকিছু হারিয়ে ফেলছি।" মায়ের এ কথা আমি হেসে উড়িয়ে দেই। প্রতিটা মানুষ জীবনের একটা সময় এসে অনুভব করে সে হয়তো সবকিছু হারিয়ে ফেলছে। সত্যিকার অর্থে মানুষ কিছু হারায় না। প্রকৃতি এতোটা নিষ্ঠুর নয় যে সবকিছু কেড়ে নেবে। প্রকৃতি যা কেড়ে নেয় তাই ফিরিয়ে দেয়। তাই আমি মার কথা এতোটা আমলে নেই না। সেদিন মা সব কাজ শেষ করে দুপুরে স্বাভাবিক ভাবে ঘুমাতে যান। সেই ঘুমেই স্বামী-সন্তান সব হারিয়ে মা পরপারে চলে যান। আর সেদিন রাতেই আমি ফুটফুটে দেবশিশুর মত একটা ছেলের জন্ম দেই। নিয়তি এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ না করলেও পারতো।
মায়ের শূন্যতা বাবাকে বেশিদিন ব্যথিত করলো না। মায়ের মৃত্যুর চার মাস পর বাবা একদিন রাতে আমার ঘরে এলেন। ঘরে এসে আমার বাচার সাথে অনেক্ষণ খেলা করলেন। চলে যাওয়ার সময় স্বাভাবিক গলায় আমাকে বললেন,
-" আশা শোন। তোর তো সবেমাত্র বাচ্চা হয়েছে। তুই তো সব কাজ করতে পারিস না। কিন্তু তোর যত্ন নেওয়ার জন্য একটা মানুষ দরকার।" বাবার কথার মানে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই বাবাকে বললাম...
-" তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো বাবা।" আমার কথার বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। তার তিনদিন পরই বাবা নতুন বিয়ে করলেন।
ছোটমা দেখতে সুন্দর। খুব শান্ত স্বভাবের। প্রথম কিছুদিন তিনি আমার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করলেন। হঠাৎ কি যেন উনার হলো। তিনি নিয়ম করে তিনবেলা আমাকে খোঁটা দিতে শুরু করলেন। আমি ভাত খেতে বসলেই তিনি প্রায় চিৎকার করে বলেন,
-" জামাইয়ের ভাত কিভাবে খেতে হয় তোর মা তো তোকে তা শিখায়নি। এখন বসে বসে বাপের গুলো খাচ্ছিস। তোর মরণ হয় না কেন?" ছোট মায়ের এই কথা শুনার পর ভাত আর গলার নিচে নামতে চায় না। তবুও আমি খাওয়ার চেষ্টা করতাম। কারণ আমি না খেলে আমার বাচ্চা খাবে কি? বাবা অবশ্য এসব শুনে কিছুদিন ছোটমার সাথে চিৎকার চেচামেচি করলেন। আস্তে আস্তে বাবার কাছে এসব স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আমিও এসব কথা গায়ে না মেখে নিজের ছেলেকে নিয়ে মেতে রইলাম। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই আর কোনো কষ্ট অনুভব হয় না।
একটা বছর আমি খোঁটা শুনে শুনে কাটিয়ে দেই। হঠাৎ একদিন রাতে বাবা আমার ঘরে এসে বসলেন। বাবাকে দেখেই আমার ছেলে নিরব দু'হাত তুলে বললো, 'নান-নাহ।' আমার ছেলের এই ডাক বোধহয় বাবার হৃদয় ছুতে পারেনি। তিনি আমার ছেলের দিকে না তাকিয়ে আমার হাতে পাঁচ হাজার ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
আশা। পেটের চামড়া কখনো পিঠে লাগে না। তোর তো আর সংসার হলো না। আমি নতুন সংসার শুরু করে ভুল করেছি। মা তুই এই টাকা গুলো নিয়ে অন্য কোথাও চলে যা। এইটুকু বলে বাবা কান্না শুরু করলেন। অবশ্য আমি বাবার কথায় একটুকুও অবাক হইনি। তবে এটা বুঝতে পারি প্রতিটা বাবা নিজের মেয়েকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
পরদিন সকালে নিরবকে নিয়ে বাবার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই। ভালো কোনো বাসা না পেয়ে একটা বস্তিতে গিয়ে উঠি। অল্প ভাড়ায় সেই বস্তিটাই আমার ঠিক মনে হয়। ভালো কোনো চাকরি করার আমার যোগ্যতা নেই। আর আমি গার্মেন্টসেও চাকরি করতে পারবো না। গার্মেন্টসে গেলে আমার নিরবকে কে দেখবে? তাই একটা বাসায় কাজের বুয়ার কাজ নেই। সে বাসায় আমার ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আছে। আর তারাও আমার ছেলেকে খুব আদর করে।
আমার নিরবের বয়স তখন দুই বছর। টুকিটুকি সে হাঁটে, খেলে। একদিন নিরব খেলতে খেলতে সে বাসার একটা গ্লাস ভেঙে ফেলে। এটা দেখে সে বাসার মালকিন আমার ছেলেকে একটা চড় মাড়ে। প্রায় সাথে সাথেই আমার নিরবের ফর্সা গালে আঙুলের ছাপ পড়ে যায়৷ আমি সেদিনই সে বাসার কাজ ছেড়ে দেই৷ তার তিনদিন পরই সে বাসার বাচ্চার লাশ পাওয়া যায়। একজন মায়ের সামনে সন্তানকে মারলে মায়ের কতটুকু কষ্ট হয় তিনি সন্তান হারিয়ে এখন বুঝতে পারছেন।
Post a Comment